মাসুদ মজুমদার:
জনগণ ভুল করলে সামান্য ক্ষতি। রাজনীতিবিদেরা ভুল করলে মহাক্ষতি। সরকার ভুল করলে জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজ ভুল করলে জাতির ও জনগণের ভোগান্তি বাড়ে। ব্যবসায়ীরা ভুল করলে সরকার আশকারা পায়। আইনের লোকেদের ভুল জনগণের আস্থায় চিড় ধরায়। বিচারকদের ভুল নৈরাজ্যের জন্ম দেয়। প্রতিশোধস্পৃহা বাড়ে। প্রতিহিংসার আগুন জ্বালায়। প্রশাসনের ভুল রাষ্ট্রের কাঠামোকে ধসিয়ে দেয়। সরকারকে ভুল পথে নিয়ে যায়।
মানুষ নিজস্ব সীমাবদ্ধতার কারণে ভুল করবেই। কিছু ভুল ইচ্ছাকৃত। অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য মানুষ দায়মুক্তি পায়। সেই ভুলের স্বীকৃতি ও ভুল সংশোধনের উদ্যোগ একটি মানবিক গুণ। এটি মৌলিক মানবিক ও নৈতিক গুণকে আরো শানিত করে। কথায় আছে, শিক্ষিত মানুষের ভুলের খেসারত বেশুমার। মনে হয় আমরা সবাই ভুলের রাজ্যে ও ভুলের আবহে বাস করছি। এখন প্রতিনিয়ত সরকার ভুল করছে, আর পাপের বোঝা বাড়াচ্ছে। প্রবাদ হচ্ছে, শাসকেরা বিপথগামী হলে বিধাতা তাদের বারবার ভুল করান, যা তাদের পতনের কার্যকারণ হয়ে দাঁড়ায়। সরকার ও আওয়ামী জোট ধরেই নিয়েছে খালেদা জিয়া এখন আন্দোলন-সংগ্রামের একমাত্র প্রেরণার উৎস, জামায়াত-শিবির আন্দোলনের শক্তি। এ দু’টি ধ্বংস করে দিলেই আন্দোলনের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে। হ্যাঁ, ‘ধ্বংস’ শব্দটি সজ্ঞানেই ব্যবহার করেছি। অথচ আমরা কেউ খালেদা জিয়া ও জামায়াত-শিবিরকে আন্দোলনের লিজ দিইনি। এত শক্তি গণতন্ত্র ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য লড়াই করছে, অথচ তাদের কোনো ভূমিকাই সরকার বিবেচনায় নিচ্ছে না। কেন! এর জবাব সহজ। বি. চৌধুরী, ড. কামাল, আ স ম রব, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সবাই একবার ভাবেন গণতন্ত্রের কথা; সাতবার ভাবেন ফসল খালেদা জিয়া ও জামায়াত-শিবিরের গোলায় উঠল কি না। এ দ্বিধাই তাদেরকে সামনে আসতে দিচ্ছে না। ইতোমধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যা সব সীমা অতিক্রম করেছে। গ্রেফতার করে নাই করে দেয়া হচ্ছে। পঙ্গু করে দেয়া, নয়তো জেলে পুরে দেশের জেল ভর্তি করাকে সরকার মোক্ষম দাওয়াই কিংবা সমাধান ভাবছে। শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়াকে বন্দী করারও গুজব শুনছি। ইতিহাস পড়ে জেনেছি এবং নিকট-অতীতের সাক্ষী হয়ে আছি, কাউকে হত্যা করে ও বন্দী করে আন্দোলনের গতি রোধ করা যায় না। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ঠেকে থাকেনি। ইমাম খোমেনি প্যারিসে নির্বাসিত ছিলেন তার জনগণ বিপ্লবকে ষোলোকলায় পূর্ণ করতে কম রক্ত ঠেলে এগোয়নি। কৃষ্ণসুন্দর নেলসন ম্যান্ডেলা তিন দশক কারাগারে থেকেই প্রেরণা জুগিয়েছেন। নবী-রাসূলদের ইতিহাস নাই বা টানলাম। চেয়ারম্যান মাও, কার্ল মার্কস, লেনিনসহ মাত্র বিগত দুই শতকের ইতিহাসে জনগণের আন্দোলন প্রমাণ করে জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন, গুম, হত্যা, জেল-জরিমানা, অপহরণ কোনো আন্দোলনকে থামিয়ে দেয় না; বরং বাঁক ঘুরিয়ে দিয়ে আরো বেগবান করে। জনগণের সিমপ্যাথি ও পরিবর্তনকামী মানসিকতা তাদের সাথে যোগ হয়।
আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা ভেবেছেন, বিরোধী দলের অর্ধেককে জেলে রেখে, অর্ধেককে হত্যা করে গল্প সাজিয়ে কিস্তি মাত করে দেবেন এ অঙ্ক শুধু ভুলই নয়, আত্মঘাতীও। মজলুম ও নির্দোষ মানুষের লাশ তার তিন পুরুষকে সরাসরি অনুপ্রাণিত করে যায়। তা ছাড়া যারা ভাবেন জান বা প্রাণটা ছাড়া তাদের আর কিছুই হারানোর নেই। এরা মৃত্যুকে জয় করে ফেলে। খালেদা জিয়া বলেই দিয়েছেন, তিনি ভয় করেন না, জয়কে ছিনিয়ে আনতে যা করার তাই করবেন। ইতিহাস বলে, অবাঞ্ছিত ও গণবিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ দমন করা যায়; কিন্তু আন্দোলন ঠেকানো যায় না। দেশে কোনো রাজনৈতিক শক্তি বিদ্রোহ করেনি। জনগণের পরিবর্তনের মানসিকতাই তার প্রমাণ। কারণ জনগণ ভোট দিতে পারেনি, বঞ্চিত হয়েছে। তারপর গণতান্ত্রিক অধিকার হারিয়ে বসেছে। এখন মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত। এই বঞ্চনাই বিরোধী দলের শক্তিকে অপ্রতিরোধ্য করে দিয়েছে। সরকার চেয়েছিল রাজনৈতিক সঙ্কট আড়াল করতে। এখন রাজনৈতিক সঙ্কট আরো বীভৎস রূপ নিয়ে সরকারের সামনে ভীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একই কারণে সরকার নৈতিকভাবে টিকে থাকার শক্তি হারিয়েছে। তাই অস্ত্রের ভাষায় অঙ্ক মিলানোর চেষ্টা করছে। এরা ধরেই নিয়েছেন একসময় অস্ত্রের মুখে জনশক্তি হারিয়ে বিরোধী দল খেই হারিয়ে ফেলবে। তারপর ঘরে ঢুকে যাবে। ঘরে বসে শোকের মাতম করে সময় পার করবে। আর সরকারি দল দাপুটে শাসনের ঘোড়ায় চড়ে জনগণকে খুশি করে নেবে। জনগণ বিচারবহির্ভূত হত্যার মিছিল, রক্তের দাগ, খুনের আহাজারি, বার্ন ইউনিটের রোনাজারি, অপহরণের সব শোক ভুলে যাবে। আসলে ভুলটা এ ধরনের স্থূল মূল্যায়নের কারণেই এক অতলস্পর্শী সঙ্কটের জন্ম দিয়ে চলেছে।
বাম জোটের ছোট দলের বড় নেতারা মনে করেন, নৌকায় থেকে যতটা কুড়ানো যায় সবটুকু লাভ। একই ধারার বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন, এই সুযোগে জাতীয়তাবাদী ইসলামি শক্তি নিমূর্ল হয়ে গেলে তারা মাঠে এসে জনমতকে নিজেদের গোলায় তুলবেন। এই অঙ্কের ভুল তাদেরকে শুধু অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলছে না, বাংলার জমিনে তাদের রাজনীতিকে মৃত্যুর দুয়ারে তারা নিজেরাইপৌঁছে দিচ্ছেন।
তারা ভাবছেন সত্যনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ হয়ে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, নিরপেক্ষ নির্বাচন ও মৌলিক অধিকার নিয়ে কথা বললে খালেদা জিয়া ও তার জোট লাভবান হয়ে যাচ্ছে। এই ভাবনা খালেদা জিয়ার একক অবস্থান আরো দৃঢ় করছে। একসময় টের পাবেন আসলে খালেদা জিয়া ও তার জোটের লাভালাভ এরা ঠেকাতে পারছেন না; বরং নিজেরা বর্ণচোরা ও অগণতান্ত্রিক শক্তি হয়ে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। এ কারণেই রাজনীতির তৃতীয় শক্তি আজো অস্তিত্বহীন।
জাসদের কোনো কোনো নেতা যারা সরকারে আছেন, তারা ধরেই নিয়েছেন এ নগদ পাওয়ার খেসারত আছে। কিন্তু এরা এ যাত্রা জিতে থাকতে চান। আগামী দিনের লড়াইয়ে হেরে যাবেন, এই মূল্যায়ন তাদেরও আছে।
এরশাদ-রওশন দু’নৌকায় পা দিতে গিয়ে আবার আনপ্রেডিক্টেবল ও স্খলিত রাজনীতির গন্ধ মাখলেন। অথচ ঋজু ভাষায় সত্যনিষ্ঠ হয়ে এককথায় থাকলে তারা ছাগলের তৃতীয় ছানা ও কোলবালিশ না হয়ে এবার অন্তত গণতান্ত্রিক শক্তির কাতারে উঠে যেতে পারতেন। তাতে ঝুঁকি ছিল। ক্ষতি ছিল না। অঙ্কটা এবারো জাতীয় পার্টি ভুল করে মেলাতে পারল না। জাতীয় পার্টি আবারো অবস্থান পরিবর্তন করবে। এই পরিবর্তন যেকোনো পরিবর্তনের রাজনীতির জন্য অনিবার্য। তাই জাতীয় পার্টির ভূমিকা আশু পরিবর্তনের ইঙ্গিতও হতে পারে। কারো পরামর্শে রাজনৈতিক শত্রু ও বন্ধু নির্বাচন করা হয় না। একসময়ের শত্রু অন্য সময়ে মিত্র হয়ে যায়। জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে এই রাজনীতি করার কথা ছিল না। কারণ তারা ঐতিহ্য ও ইতিহাসগতভাবে পরস্পরবিরোধী ছিল। এখন রাজনীতির স্বার্থে একসাথে খেলছে। তাই যারা খালেদা জিয়াকে জামায়াত ছাড়তে, আওয়ামী লীগকে এরশাদ ছাড়তে বলছেন তারাও অঙ্কে ভুল করছেন। কারণ এই সময়ে কেউ বন্ধু বদলাবে না; বরং ন্যূনতম ইস্যুতে বন্ধুর সংখ্যা বাড়ানোটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া যারা মধ্যস্থতা চান, সমাধান খোঁজেন; তারা পক্ষগুলোর শত্রু-মিত্রের ব্যাপারে শতভাগ নিরপেক্ষ না থাকলে তারা আম্পায়ার না হয়ে খেলোয়াড় হয়ে যাবেন।
অঙ্কের ভুল বিএনপিরও আছে। তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও কৌশল, বাম ঘরানার লোকেদের সতীত্বহীন অবস্থান, আদর্শিক বিচ্যুতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন বিলম্বে। তারা ক্ষমতার বেনিফিসিয়ারিদের মরণকামড়ের বিষয়টি আমলে নেননি। কায়েমী স্বার্থবাদীদের শ্রেণীচরিত্র তাদের মগজেই ছিল না। তা ছাড়া মিত্র বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের হাতে থাকা শেষ স্পেসটুকুও দিতে পারতেন।
সরকার তাদের বিরুদ্ধে যে অস্ত্রগুলো ব্যবহার করছে, সেগুলোকে তারা অস্ত্র বিবেচনা করেননি। ভেবেছেন জনগণ গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার নিয়েই ভাববে, সরকারের ভোঁতা অস্ত্র আমলে নেবে না। জনগণকে যে সাময়িক বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয়েছে, সেটা মেনে নেয়া ভালো। ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ বিপ্লবের স্লোগান দিয়ে জাতীয়তাবাদী ইসলামি শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবের আওয়াজ তুলে থামেনি। তারা রীতিমতো প্রতিবিপ্লবী ধ্বংসের নামে যুদ্ধ করেছে। তখন বিএনপি বুঝতে চায়নি মিত্রহীন করে একসময় খালেদা জিয়ার বিএনপির ওপর মরণকামড় হানবে। সরকার যখন আইন, বিচার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ব্যবহারের জন্য সাজাচ্ছিল তখনো বিএনপি কাক্সিত প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তাই শাহবাগ নাটক, তর্কিত বিচার। হেফাজতের ওপর হামলার মতো ইস্যুতেও বিএনপি জোট দৃঢ় অবস্থান নেয়নি।
সামনে সংলাপ নাটক মঞ্চায়নের উদ্যোগ চলছে। রাজনৈতিক সমঝোতা অবশ্যই হতে হবে। তবে অর্থহীন রাজনৈতিক আলাপচারিতার চেয়ে জনগণকে সাথে নিয়ে দৃঢ় থাকাটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকার আলোচনার অদৃশ্য ও দূরতম টোপ ফেললেও এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা এবং একুশের ঢাল এখনো হাতে রেখেছে। বার্ন ইউনিট ও পেট্রলবোমার বীভৎস কাহিনী, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের মতো নিষ্ঠুর বিষয়গুলোকে প্রচারণা ও প্রতারণার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার সময় শেষ। জনগণ এখন সব কিছু ফকফকা দেখতে পাচ্ছে। কার দায় কতটুকু তা-ও দেখছে। মিডিয়ার অঙ্কের ভুলটা বড় মাপের। তারা জনগণের চাহিদা ভুলে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। তাদের সামনে মুখে মধু ও অন্তরে বিষ নিয়ে যে ভীতির গান শোনানো হয়েছে, সেটা তাদের আদর্শ বস্তুনিষ্ঠতা ও সত্যাসত্য ইমেজের টুঁটি চেপে ধরেছে। অথচ তারা টেরও পেলেন না যা গিলে যাচ্ছেন তা গণতন্ত্রের জন্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গলা টিপে হত্যার শামিল। এই অবিশ্বস্ত মিডিয়া যখন ক্ষমতার প্রশ্রয় থেকে বের হয়ে চোখ খুলে তাকাবে, তখন শুধু অন্ধকারই দেখবে না, তাদের সামগ্রিক পেশাদারিত্বের দৈন্য ও অস্তিত্বসঙ্কট দেখে আঁতকে উঠবে।