থমকে গেছে ‘লন্ডনী বিয়ে’র ধুম
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ইং, ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ | সংবাদটি ১০৯০ বার পঠিত
মোহাম্মদ আলী শিপন::প্রবাসি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত বিশ্বনাথ উপজেলা। উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ যুক্তরাজ্য দীর্ঘদিন ধরে স্ব-পরিবারে বসবাস করে আসছেন। কিন্তু বর্তমানে লন্ডনী বিয়ের ধুম নেই উপজেলায়। লন্ডনী বিয়ে লন্ডন-বিশ্বনাথ সর্ম্পককে বিশেষ মাত্রায় পৌছে দিয়েছিল। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। স্থানীয় পারিপার্শ্বিক অবস্থাসহ ব্রিটেন স্পাউস ভিসা শর্ত কঠোর করায় কমে গেছে লন্ডনী বিয়ের আয়োজন। দেশে আশা প্রবাসীর সংখ্যা আগের চেয়ে কয়েক গুণ কমে গেছে। জরুরী কাজ ছাড়া দেশে আসছে না প্রবাসিরা।
জানাগেছে,মধ্যপ্রাচ্য ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ বসবাস করে আসছেন। এরই মধ্যে সিংগভাগ মানুষ স্বপ্নের দেশ ব্রিটেনে পরিবার-পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। এছাড়া বৈবাহিক সূত্রে দীর্ঘতর হয়েছে ব্রিটেনে বিশ্বনাথীদের যাতায়াত। এলাকার মেধাবী ও সুন্দর ছেলে মেয়েদের বিরাট অংশ লন্ডনী আতœীয় স্বজনের সাথে বৈবাহিক সর্ম্পকে পাড়ি দিয়েছে সেই স্বপ্নের দেশ লন্ডনে। ফলে অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভ হয়েছে বিশ্বনাথে। ব্রিটেন সরকার স্পাউস ভিসা র্শত কঠোর করায় এই অবস্থায় বাংলাদেশী তথা বিশ্বনাথের যারা ব্রিটেনে বসবাস করেছেন,তারা এই কঠোর শর্তারোপের কারণে ছেলে বা মেয়েকে নিয়ে দেশে এসে বিয়ে দিতে সাহস পাচ্ছেনা। মূলত ব্রিটেন সরকার স্পাউস ভিসায় স্বামী কিংবা স্ত্রীকে ব্রিটেনে নিয়ে যেতে বছরের বিরাট অংকের টাকা আয় সীমা বেঁধে দেয়া কারণে প্রতিবছর অসংখ্যক স্পাউস ভিসা প্রার্থী বাধাগ্রস্থ হচ্ছেন।
লন্ডনে বসবাসকারী প্রবাসি বিশ্বনাথের বেশিরভাগ মানুষ নিজ দেশে (বাংলাদেশে) এনে সন্তানদের বিয়ের আয়োজন করে থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে এ প্রচলন চলে আসছিল। ব্রিটেন প্রবাসি বর কনেদের দেশে এসে বিয়ে করার এই লন্ডনী বিয়ের হারও স্পাউস ভিসায় শর্তারোপের কারণে অনেকটা কমে গেছে। ব্রিটেনের আইনে ইউরোপ বাইরে থেকে স্পাউস আনতে স্পন্সরের বছরের কমপক্ষে ১৮ হাজার পাউন্ড আয় দেখাতে হবে।
এলাকাবাসি জানান, শীত মৌসুম কিংবা ঈদ আসলে উপজেলা প্রচুর প্রবাসিরা স্বপরিবারে দেশে নারী টানে ছুটে আসতেন। গত বছর হাত-গোনা কয়েকজন যুক্তরাজ্য প্রবাসি দেশে এসেছেন। প্রবাসি যারা দেশে এসেছেন তারা দুই-এক সপ্তাহ দেশে অবস্থা করে ফের কর্মস্থলে ছুটে যাচ্ছেন। জরুরী কাজ না ছাড়া দেশে আসতে চান না অনেক প্রবাসি। গ্রীষ্মকালিন ছুটি নিয়ে শীত মৌসুম আসলে যুক্তরাজ্য প্রবাসি পরিবারগুলো ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য দেশে আসতেন। কিন্তু গত দুই বছর ধরে উপজেলায় প্রবাসির সংখ্যা কম আসায় নল্ডনী বিয়ের সংখ্যাও অনেক কম গেছে। কিন্তু এখন হাত-গোনা কয়েকজন প্রবাসিকে কে এলাকায় মাঝে মধ্যে দেখা যায়। আগে যেখানে উপজেলায় প্রতি মাসে ১০-১৫টি লন্ডনী বিয়ে হত, এখনও ছয় মাসেও দুটি বিয়ে দেখা যায় না। বিশ্বনাথে লন্ডনী বিয়ের আয়োজন করা হলে অনেকই উপকৃত হতেন। ব্যবসা-বাণিজ্যও চাঙ্গা হত। বর্তমানে এলাকার তরুণরা লন্ডনী বিয়ের আসা অনেকটা ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্টানে জড়িয়ে পড়ছেন।
এলাকাবাসি আরোও জানান,বিশ্বনাথে থাকা অনেক ঘঠকরা (রায়বাররা) রয়েছেন বিপাকে। তাদের মনেও কষ্টের শেষ নেই। পূর্বে থেকে তারা দেশে থাকা প্রবাসিদের আতœীয়-স্বজনদের কাছ থেকে জেনে নিতেন কবে আসছেন কোন প্রবাসি। যুক্তরাজ্য প্রবাসিরা দেশে আসলে তারা ছুটে যেতে তাদের বাড়িতে। প্রবাসির ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হবে কি না খোঁজ খবর রাখতেন। তাদের মাধ্যমে কোন প্রবাসি নারী-পুরুষের বিয়ে হলে ভাল অর্থ উর্পাজন হত। কিন্তু প্রবাসিরা স্বপরিবারে দেশে না আশায় তারা রয়েছেন দুঃচিন্তায়। এলাকায় ঘঠকদেরও তৎপরতা কমে গেছে। উপজেলায় ঘঠকের সংখ্যাও পূর্বে মত দেখা যায় না। ফলে অনেকেই সিলেট শহরে পাড়ি জমিয়েছেন।
যুক্তরাজ্য অবস্থারত কয়েকজন প্রবাসির সাথে আলাপকালে জানাযায়, বর্তমানে প্রবাসে বসবাসরত মানুষ ছেলে-মেয়েদের নিয়ে দেশে যেতে নারাজ। তবে যারা যাচ্ছেন,তারা জরুরী কাজ বা দেশে থাকা আত্বীয় স্বজনদের দেখার জন্য। তবে কয়েকদিন দেশে অবস্থান করে ফের তারা কর্মস্থল ছুটে আসছেন।
তারা বলেন, দেশে নিয়ে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার চিন্তা আগের মত এখন আর অনেক প্রবাসির নেই। কারণ বিয়ের পর বর কিংবা কণে কে আনতে অনেক অর্থ উপার্জন করতে হবে। এতে সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে অনেকই বাধ্য হয়ে লন্ডনে ছেলে-মেয়ের বিয়ের অনুষ্টান করে আসছেন।
সদ্য দেশে আসা যুক্তরাজ্য প্রবাসি মনির মিয়া বলেন, তিনি স্বপরিবারের দেশে আসার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে দেশের অবস্থা দেখে ছেলে-মেয়েরা আসতে চায়নি। তাই তিনি একা দুই সপ্তাহের জন্য দেশে এসেছে। আগামিকাল শনিবার ফের প্রবাসে চলে যাবেন।
ঘঠক আলা উদ্দিন বলেন, শীত মৌসুম আসলে অনেক প্রবাসি দেশে আসতেন। কিন্তু গত দুই বছর তেমন কোন প্রবাসি বর-কণে পরিবার উপজেলায় দেখা যায়নি। যার ফলে লন্ডনী বিয়ের অনুষ্টান অনেক কম হচ্ছে। গত নয় মাস ধরে লন্ডনী কোন বর-কনের পাওয়া যায়নি। ফলে পবিবার পরিজন নিয়ে রয়েছি অনেকা বিপাকে।
উপজেলা সদরের মুদি দোকান ব্যবসায়ী বাবুল মিয়া বলেন, এলাকায় লন্ডনী বিয়ের আয়োজন কম হওয়ায় প্রবাসি ক্রেতার সংখ্যা নেই বললেই চলে। আগে যেখানে লন্ডনী বিয়ের অনুষ্টানের ক্রেতা প্রতি মাসে দুই-চার জন্য পাওয়া যেত। কিন্তু এখন তিন মাসেও একজন পাওয়া যায় না।
আল-আছকা মার্কেটের সৌখিন বিপনী সেন্টারে পরিচালক রুহেল আহমদ কালু বলেন, লন্ডনী বিয়ের সংখ্যা এলাকায় কয়েক গুণ কমে গেছে। ফলে আগে যেখানে বিয়ে শাড়ি প্রতি মাসে চার-পাঁচটি বিক্রয় করা যেত। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে লন্ডনী বিয়ের শাড়ি বিক্রয় করতে পারিনি। ফলে ব্যবসায় অনেকটা মন্দাভাব দেখা দিয়েছে।
উপজেলা সদরের শাহনাজ বিউটি পার্লারের পরিচালক শাহানা বেগম বলেন, আগে যেখানে প্রতি সপ্তাহে দুই-একজন লন্ডনী কণ্যা কে সাজিয়ে দেওয়া হত। এখনও মাসেও একজন পাওয়াও কষ্টকর। এলাকায় লন্ডনী বিয়ে অনেক কমে গেছে।
মাইক্রো গাড়ি চালক কবির মিয়া বলেন, বছরের শেষ দিকে ও প্রথম দিকে প্রবাসিরা বেশিরভাগ দেশে প্রবেশ করেন। দেশে এসে তারা মাসব্যাপি গাড়ি ভাড়ায় নিয়ে যান। তারা বিশ্বনাথে গাড়ি না পেলেও সিলেট শহর থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসতেন। বিয়ের অনুষ্টান হলেও সিলেট শহর থেকে নামি-দামি গাড়ি বর বা কণের জন্য ভাড়া করা হত। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে লন্ডনী বিয়ের সংখ্যা কমে গেছে।
উপজেলা সদরের সাদ্দাম ডেকোর্টাসের পরিচালক ফিরোজ আলী বলেন, অতিথিতের মতো এখন উপজেলায় লন্ডনী বিয়ের অনুষ্টানের গেইট কিংবা গায়ে হলুদের ওয়ার্ডার পাওয়া যায় না। আসছে শীত মৌসুমে হয়ত প্রবাসিরা দেশে আসতে পারেন। ফলে লন্ডনী বিয়েও বেড়ে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
মা-মনি কমিউনিটি সেন্টারের পরিচালক শেখ ছুরুক মিয়া বলেন, এখনও আর আগের মতো লন্ডনী বর-কণের বিয়ের অনুষ্টানের জন্য সেন্টার ভাড়া করা অনেক কমে গেছে।